দেশে খাদ্য সুরক্ষার দাবি যখন জোরালো হচ্ছে
তখন সরকারি খাদ্য সংগ্রহ ও বণ্টন ব্যবস্থা ততই অবহেলিত হচ্ছে। বলা যায় সরকারি উদ্যোগে খাদ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বণ্টন
সামগ্রিক বিষয়টি খাদ্য সুরক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সামনে এক প্রশ্ন তুলে
দিয়েছে। অথচ, দেশে খাদ্য সুরক্ষা ও গণবণ্টন ব্যবস্থা
দৃঢ় করার লক্ষ্যে ভারত সরকার সান্তা কুমারের নেতৃত্বে অগস্ট, ২০১৪ সালে এক উচ্চ পর্যায়ের
ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তাঁদের
সুপারিশে কৃষকের নিকট থেকে খাদ্য সংগ্রহ, গুদামজাত করা ও তা সামগ্রিক গণবন্টন ব্যবস্থার
মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সহ খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি জোরদার করার
ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ভারত সরকারের
সান্তা কুমার কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যও ছিল ভারতের খাদ্য সরবরাহ নিগম(এফসিআই) দ্বারা খাদ্য
শস্য সংগ্রহে আরও উন্নত পদ্ধতি আরোপ করার পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থাকে সংহত করা।
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি দেশজুড়ে বিভিন্ন স্তরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট
সংস্থাগুলির সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ ও তা নথিভুক্ত করণের কাজ করেন। এ ব্যাপারে দেশের সংবাদ মাধ্যমে মতামত জানানোর জন্য বিজ্ঞাপনও
দেওয়া হয়। ওই কমিটি ভারতের
খাদ্য সরবরাহ নিগম গঠনের ও খাদ্য সুরক্ষার বিষয়ে তাদের উদ্দেশ্য কতখানি সফল তা বিবেচনা
করে কিভাবে এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা যায় তা খতিয়ে দেখে। নিগমকে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনে সেদিকে নজর দেওয়া
হয়।
প্রসঙ্গত, ফুড করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৬৪ অনুযায়ী
১৯৬৫ সালে ভারতের খাদ্য সরবরাহ নিগম গঠিত হয়েছিল। সকলেরই জানা একসময় আমদানিকৃত পিএল-৪৮০ গমের ওপর নির্ভরশীল
হয়ে পড়তে হয়েছিল দেশকে। দেশের তখন পর্যাপ্ত
বিদেশী মুদ্রা ভাণ্ডারও ছিল না বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করার মত। মনে রাখা দরকার তখন মেক্সিকো থেকে উচ্চ ফলনশীল গমের বীজও
আমদানি করতে হত। এরকম এক জায়গায়
দাঁড়িয়ে সেদিন এফসিআই তৈরি করা হয়েছিল। পাশাপাশি ১৯৬৫
সালেই গঠন করা হয়েছিল এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন। লক্ষ্য ছিল কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়। এফসিআই কি তিনটি বিষয় বাধ্যতামূলক ভাবে দেখার লক্ষ্য স্থির
করে দেওয়া হয়েছিল, (এক) কৃষকদের কার্যকরী সহায়ক মূল্য প্রদান (দুই) খাদ্য সংগ্রহ ও গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে তা সমাজের
বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া (তিন) বাজারে খাদ্য শস্যের মূল্য ঠিক রাখার জন্য
কৌশুলী খাদ্য সংরক্ষণ করা।
কিন্তু এফসিআই খাদ্য সুরক্ষার এই লক্ষ্য পূরণ
করতে কোনও দক্ষতার পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়নি। একটি বৃত্তের মধ্যেই খাদ্য শস্য ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য সুরক্ষার
বিষয়ে এফসিআই ঘুরপাক খেয়েছে। খাদ্য সংগ্রহের
সুফল কয়েকটি রাজ্য ব্যতীত দেশের আপামর কৃষকের কাছে যেমন পৌঁছয়নি তেমনি সামগ্রিক গণবণ্টন
ব্যবস্থায় বহু ফাঁক-ফোকর থেকে গেছে।
উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সুপারিশ সমূহঃ
·
বিগত বছরগুলির অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এফসিআই অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগঢ়, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, ওডিশা
ও পঞ্জাব থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। মিল মালিকের কাছে না বিক্রি করে যে সব রাজ্যে খাদ্যে ঘাটতি
রয়েছে সেখানে সরকারি ব্যবস্থায় খাদ্য সরবরাহ করা। এছাড়া যে রাজ্যগুলিতে কৃষক অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয় সেখানে বাজার সহায়ক মূল্য দিয়ে কৃষকের উৎপাদিত ফসল কিনে
নেওয়া। মূলত এই রাজ্যগুলিতে ছোট, প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা
বেশী। রাজ্যগুলি হল পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ,
অসম। এই এলাকায় দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব প্রত্যাশিত ছিল। উপরোক্তএলাকায় এফসিআই-এর আরও সক্রিয় হয়ে রাজ্য সরকার ও অন্যান্য
এজেন্সি বা সংস্থাগুলিকে বাজার সহায়ক মূল্য পাওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।
·
খাদ্য সংগ্রহ দফতর ও এফসিআই-কে প্রতিটি ফসলের মরসুমে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির
সঙ্গে আলোচনা করে খাদ্য শস্যের দাম নির্ধারণের পাশাপাশি বাজার সহায়ক মূল্য ও প্রয়োজনীয়
নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
·
নিবন্ধিত গুদামে কৃষকের উৎপাদিত শস্য জমা দিয়ে উৎপাদিত ফসলের মূল্যের ৮০ শতাংশ
ব্যাঙ্ক থেকে অগ্রিম নিতে পারবে এমন ব্যবস্থা করা। এরপর বাজার সহায়ক
মূল্যের অধিক বাজার দামের সময় বা কৃষক তাঁদের ইচ্ছে মত সেই ফসল বিক্রি করতে পারবে। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের উদ্যোগে এফসিআই ও ওয়ারহাউজিং ডেভলপমেন্ট
রেগুলেটরি অথরিটি উন্নত প্রযুক্তির এই ধরনের গুদাম তৈরিতে উৎসাহিত করবে। যেখানে কৃষক দৈনিক, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে শস্য মজুত রাখতে পারবে।
·
ভারত সরকারকে বাজার সহায়ক মূল্য খতিয়ে
দেখতে হবে। বর্তমানে ২৩ টি
পণ্যের ওপর বাজার সহায়ক মূল্য ঘোষণা করা হয়ে থাকে। উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ডাল ও তৈলবীজের উন্নত বাজার সহায়ক মূল্য
চালু করা উচিত বলে মনে করে। যা কখনও বাজার
সহায়ক মূল্য থেকে কোনও মতেই কম হবে না।
গণবণ্টন ব্যবস্থা বিষয়ক সুপারিশ সমূহঃ
·
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ভারত সরকারকে এনএফএসএ-র প্রতিশ্রুতি ও কার্যকারিতার ওপর দৃষ্টিপাত
করতে সুপারিশ করে। দেশের গণবণ্টন
ব্যবস্থায় নানা খামতি রয়েছে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ। কোনও কোনও রাজ্যে এর হার ৬০-৭০শতাংশ। ভারত সরকার গণবণ্টন ব্যবস্থার সমস্ত তথ্য কম্পিউটারে নথিভুক্ত করেনি। বেনিফিসিয়ারিদের কোনও তালিকা অনলাইনে নেই যা দেখে তথ্য যাচাই
করা যাবে। এমনকী গণবণ্টন
ব্যবস্থায় যে দুর্নীতি রয়েছে তা দেখার জন্য কোনও তদারকি কমিটি বা ভিজিল্যান্স কমিটি
নেই।
·
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের মাথা পিছু ৭ কিলোগ্রাম
খাদ্যশস্য দেওয়ার সুপারিশ করে। কৃষি ক্ষেত্রে
বিনিয়োগ বাড়িয়ে খাদ্য উৎপাদনকে স্থিতিশীল করা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে গরিব কৃষককে সাহায্য
করার সুপারিশ করে।
·
খাদ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হওয়ার পর ছয় মাসের রেশন সত্ত্বর বেনিফিসয়ারিদের দিয়ে
দেওয়া। এর ফলে অযথা সরবরাহ ব্যবস্থার বিলম্ব ছাড়াও কৃষক
তার ঘরে খাদ্য মজুত রেখে নিশ্চিত হতে পারে। তাহলে গুদামজাত
করার যে ব্যয় তা লাঘব হবে।
·
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গণবণ্টন ব্যবস্থায় নগদ প্রদান (ক্যাস ট্রান্সফার) ব্যবস্থা
চালু করার সুপারিশ করে। এরফলে দুর্নীতি
বন্ধ হবে ও উপভোক্তা সরাসরি উপকৃত হবেন।
গুদামজাত ও বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়াবলীঃ
·
উচ্চপর্যায়ের কমিটি মনে করে এফসিআই সেন্ট্রাল ওয়ারহাউজিং করপোরেশন, স্টেট ওয়ারহাউজিং
কর্পোরেশন, প্রাইভেট এন্টারপেনর গ্যারান্টি স্কিম(পিইজি) ছাড়াও প্রতিযোগিতামূলক টেণ্ডারের
মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ ও বণ্টন ব্যবস্থা চালু করুক।
·
এফসিআই-এর পুরনো গুদামজাত ব্যবস্থা বহু বছর ধরে চলে আসছে এখানে আধুনিক প্রযুক্তির
গুদামজাত প্রক্রিয়া চালু করার জন্য প্রাইভেট সেক্টর ও অন্যান্য গুদামজাতকরণের কাজে
নিযুক্ত সংস্থাকে দায়িত্ব বণ্টন করা উচিত।
·
পরিবহনের সময় কন্টেনার ব্যবহার করা। এরফলে দ্রুত পৌঁছানো
যেমন সম্ভব হবে তেমনি রাস্তায় খাদ্য শস্য নষ্ট হবে না।
শ্রম সংক্রান্ত বিষয়ঃ
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি লক্ষ্য করেছে এফসিআই তে ১৬ হাজার বিভাগীয় শ্রমিক রয়েছে। এছাড়া ২৬ হাজার শ্রমিক রয়েছে যারা ডাইরেক্ট পেমেন্ট সিস্টেম
(ডিপিএস)এর আওতায় পরে। এপ্রিল –নভেম্বর, ২০১৪ তে একজন বিভাগীয় শ্রমিক প্রতিমাসে ৭৯হাজার৫০০ টাকা
পাচ্ছেন তখন ডিপিএস –এ একজন শ্রমিক ওই সময়কালে প্রতিমাসে পাচ্ছেন ২৬ হাজার টাকা। অথচ চুক্তি শ্রমিকরা পাচ্ছেন ওই সময়কালে প্রতিমাসে ১০ হাজার
টাকা। এফসিআই তে প্রায় ৩০০ শ্রমিক অগস্ট ২০১৪ থেকে ওই
সময়ে প্রতি মাসে ৪ লক্ষটাকা পেয়েছেন। ইনসেনটিভ, ওভারটাইম
ও প্রক্সি শ্রমিক হিসেবে বহু ক্ষেত্রে দেখানো হয়ে থাকে। এই ভাবে বহু অর্থের অপচয় হচ্ছে। কমিটির সুপারিশ, চুক্তি শ্রমিকদের অধিকাংশই কঠিন কায়িক পরিশ্রম
করে থাকেন, তাদের সুযোগ সুবিধা আরও বাড়িয়ে এই কাজ করা যেতে পারে।
কৃষককে সরাসরি সাবসিডি বা অনুদান প্রদানঃ
খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর জাতীয় স্তর থেকে কৃষক পর্যন্ত খাদ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা
একটি বৃত্তে আবর্তিত হয়ে চলেছে। সর্বোচ্চ পর্যায়
কমিটি মনে করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কৃষকদের প্রয়োজন উৎসাহ ভাতা(ইনসেনটিভ)। কমিটি হেক্টর প্রতি ৭ হাজার টাকা নগদ সাবসিডি কৃষককে দেওয়ার
সুপারিশ করেছে। অযথা বাড়তি এন,
পি, কে ব্যবহারের মাধ্যমে ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে সারে ভর্তুকি ৭২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। যা অধিকাংশ সার উৎপাদককারীর মুনাফা বাড়িয়েছে। নগদ ও সরাসরি অনুদান কৃষকের হাতে পৌঁছালে সারের যথাযথ ব্যবহার
হবে, এবং কৃষক ধার করে সুদে টাকা নিয়ে সার কিনতে বাধ্য
হবে না।
এন্ড টু এন্ড কমপিউটারাইজেসনঃ
কমিটি মনে করে খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির শুরু থেকে শেষ যেমন খাদ্য শস্য সংগ্রহ,
গুদামজাতকরণ, পরিবহন ও পরিশেষে বণ্টন সবটাই কমপিউটারাইজেসন হওয়া প্রয়োজন। এটা যথাযথ সময়ে হওয়া বা শুরু করা আশু প্রয়োজন।
এফসিআই-এর নতুন মুখঃ
এফসিআই-কে খাদ্য সংরক্ষণ ও বণ্টন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নানা সংস্থার সঙ্গে
একটি সূত্র তৈরি করে তাকে একটি গ্রন্থিতে বাঁধার কাজ প্রতিযোগিতামূলক ভাবে চালু করতে
হবে। তবেই খাদ্য শস্য সংগ্রহ, গুদামজাত করা, সু্ষ্ঠ
পরিবহন ও পরিশেষে বেনিফিসারির কাছে বিলি হওয়ার কাজ সম্পন্ন হবে। এফসিআই- কে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে হবে। ঠিক সময় বাফার স্টক-এর অতিরিক্ত (প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের বাড়তি)
গুদামজাত বাড়তি শস্য বিক্রি বা রফতানি করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই কাজ চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নিতে হবে এফসিআইকে। ১৯৬০-১৯৭০ পর্যন্ত যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব এফসিআই পালন করেছিল
এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মাধ্যমে ফের তা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।
অনুবাদঃ সুকুমার মিত্র।
Comments
Post a Comment